পাইলস বা অর্শ রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন
পাইলস বা অর্শ রোগ কি তা আমরা কম বেশি সবাই জানি।
পাইলসকে প্রচলিত ভাষায় আমরা অর্শ বা অরিশ নামে চিনি। যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় হেমোরয়েড নামে পরিচিত। বর্তমানে কম বয়সী মানুষ থেকে শুরু করে মাঝ ও বৃদ্ধ বয়সের বহু মানুষ অর্শ রোগে আক্রান্ত। মূলত মলদ্বারে রক্ত ক্ষরণ,কোষ্ঠকাঠিন্য এই রোগের লক্ষণ। কি করলে পাইলস বা অর্শ হবে না অথবা হলে কি করণীয় তা জানা না থাকার কারণে অনেকেই সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ না করে রোগ বাড়িয়ে ফেলে পরে রোগ বাড়িয়ে বিপদে পড়ে এবং মৃত্যুও ডেকে আনেন। তাই পাইলস বা অর্শ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা ভালো। আজ আলোচনা করব পাইলস বা অর্শ রোগ নিয়ে।
পাইলস কি-
ইংরেজিতে piles বা hemorrhoid কে বাংলায় অর্শ বা অরিশ বলা হয়। যা মলদ্বারের একটি রোগ। বিশেষত এই রোগটি বয়ষ্কদের মধ্যে দেখা যায় এছাড়া বর্তমানে কম বয়ষ্ক লোকজন এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যা থেকে প্রকাশ পাচ্ছে মলদ্বারের টিউমার এবং এর থেকে ক্যান্সার। আমাদের মলদ্বার টানেলের মত যার মধ্যে খাজ থাকে, এবং মল ত্যাগের সময় এই খাজ সমূহ পার হয়ে মল বেরিয়ে আসে।
কিন্তু মল যদি পরিষ্কার না হয়, কারো কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে সেক্ষেত্রে মলদ্বারে মল আটকে নানা রকম অস্বস্তির সৃষ্টি করে। এই অস্বস্তি অভ্যন্তরীণ কিংবা বাহ্যিকও হতে পারে। আবার যখন মলত্যাগের জন্যে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা হয় তখন টানেলের মত নালির অভ্যন্তরে ফেটে গিয়ে রক্তপাত হতে পারে। এই রক্তপাত কখনো বেশি কখনো কম হয়ে থাকে। পাইলস বেড়ে গিয়ে মলদ্বারে ক্ষতের সৃষ্টি করে এবং আলসার ও ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। তাই পাইলস হলে বা তার লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তার দেখানো জরুরি।
লক্ষণ-
কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া ও মলদ্বার দিয়ে মাঝে মাঝে বা নিয়মিত রক্তক্ষরণ পাইলস রোগের প্রধান লক্ষণ। এছাড়া মল ত্যাগের সময় তিব্র ব্যথা হয়ে মলদ্বার ফুলে যাওয়া অথবা মলদ্বারের মাংস বেরিয়েও আসতে পারে এই রোগে। তখন আপনা-আপনি এই মাংস আবার আগের অবস্থানে ফিরে যায় অথবা চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দিতে হয়। এছাড়া মলদ্বারে চুলকানিও হতে পারে। অনেক সময় মলদ্বারে টিউমারের কারণেও উক্ত রক্ত ক্ষরণের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। তাই রক্তক্ষরণ হলে দ্রুত ডাক্তার দেখানো উচিত এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
কারণ-
একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭৫% মানুষ অর্শ রোগের স্বীকার। অর্শ রোগ আপনার জীবন যাপনের পদ্ধতির সাথেই জড়িত। অনেক সময় অর্শ রোগ বংশগত হয়ে থাকে। বংশগত যাদের অর্শ রোগ রয়েছে তাদের অবশ্যই সাবধানতার সাথে খাবার-দাবার খেতে হয়৷
এছাড়া যে যে কারণে অর্শ রোগ হতে পারে বা বেড়ে যেতে পারে তাহলোঃ
১. কোষ্ঠকাঠিন্য।
২. পর্যাপ্ত পানি পান না করা।
৩.অতিরিক্ত ওজন হওয়া।
৪.তেল মশলা যুক্ত খাবার বেশি খাওয়া।
৫.মাত্রাতিরিক্ত মাংস খেলে অর্শ বাড়তে পারে।
৬. বংশগত অর্শ থাকলে নিয়মিত ব্যয়াম না করা।
৭.ফাইবারযুক্ত খাবার অর্থাৎ শাকসবজি না খাওয়া।
৮.বেশি সময় দাঁড়িয়ে বা বসে কাজ করা।
৯.গর্ভাবস্থায় অর্শ হতে পারে।
১০.পর্যাপ্ত না ঘুমানো।
১১. অধিক সময় শৌচাগারে ব্যয় করা।
১২. মদ্যপান ও ধুমপান করা।
এছাড়া আরো বহু কারণে অর্শ হতে পারে। তাই, হলে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ উত্তম।
হলে করণীয়-
অনেক বছরের অর্শ রোগের যন্ত্রণা সহ্য করেও রোগীরা ডাক্তারের কাছে যান। অনেকে ভুল চিকিৎসায় সময় ব্যয় করে অনেকে লজ্জায় রোগ চেপে বাড়িয়ে ফেলে যা মোটেও উচিত নয়। কারণ পাইলস বেড়ে গিয়ে জটিলতর হয়ে মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে।
কেননা পাইলসে আলসার ও ক্যান্সারের সম্ভাবনাও থাকে৷ প্রথমত,ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি কোলনস্কপি করার পরামর্শ দেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। পাইলস প্রথমিক পর্যায়ে থাকলে অপারেশনের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বেড়ে গেলে অপারেশন করতে হয়। পাইলস অপারেশনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চললে।
প্রাথমিক পর্যায়ের পাইলসের ক্ষেত্রে নিয়মিত পানি পান, শাক-সবজি খাওয়া, নিয়মিত ব্যয়াম করা,নিয়মিত মলত্যাগ করা ও অধিক পরিমাণে অসহনীয় পরিশ্রম করতে মানা করে থাকেন। যার দ্বারা প্রাথমিক পর্যায়ের পাইলস নিরাময় হয়। আপনার পাইলস কোন পর্যায়ে আছে তা বুঝতে ডাক্তার দেখিয়ে তার পরামর্শ নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী জীবন-যাপন করতে হবে।
কি করা অনুচিত-
আমরা অনেক সময় রাস্তা ঘাটে “অপারেশন ছাড়া অর্শ রোগ ভালো করুন” ধরণের লিফলেট লাগানো দেখি, যা সম্পূর্ণ ভুল বার্তা। আপনি যদি এসব লিফলেটের ফাঁদে পড়েন তাহলে নিজের জন্যে বিপদ ডেকে আনবেন। কারণ এটি ১০০% নিশ্চিত যে অপারেশন ছাড়া গুরুতর অর্শ রোগ নিরাময় সম্ভব না।
যদি কেউ এখানে লেজার পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেন তবুও না। কারণ লেজার পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী এখনো প্রচলিত নয়। এবং এটি ১০০% ভালো হওয়ার জন্যে কার্যকরী নয়।
তাই অপারেশন ছাড়া অর্শ রোগ ভালো হবে এটি একটি ভুয়া চিকিৎসা। এই ক্ষেত্রে কবিরাজ বা হাতুড়ে চিকিৎসকরা রোগীর ক্ষতি ডেকে আনে৷ যা অনেক রোগী কে মৃত্যু মুখেও ঠ্যালে দিতে পারে। যেমন, অনেক কবিরাজ মলদ্বারে এসিড প্রয়োগ অথবা ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করে যা মলদ্বার জ্বালিয়ে দিয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে এবং ভয়াবহতা ডেকে আনে।
অন্যদিকে কেউ কেউ মলদ্বারে পাউডার দেয় যার ফলে অর্শ তো ভালো হয় ই না বরং মলদ্বার সরু ও বন্ধ করার ব্যবস্থা করে। যার ফলে অর্শ আরো কঠিন আকার ধারণ করে এবং ইনফেকশনের কারণ হয়। পরবর্তীতে ডাক্তাররা বন্ধ হওয়া বা সরু হওয়া মলদ্বার অপারেশনের মাধ্যমে ফেলে দিয়ে মলত্যাগের জন্যে বিকল্প পথ তৈরি করে আলাদা ব্যাগ লাগিয়ে দেন। যা রোগীর জন্য ভয়ংকর ও কষ্টদায়ক । তাই অর্শ রোগে বিলম্ব না করে কবিরাজের কাছে যাওয়ার ভুল করার আগে ডাক্তারের কাছে যান।
চিকিৎসা-
পাইলস চিকিৎসায় রিং লাইগেশন এবং লংগো পদ্ধতির মাধ্যমে কাটাছেঁড়া ছাড়া চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে তিনটি মাংসপিণ্ড কাটার মাধ্যমে অপারেশন করা হয়, তাদের জন্যে, যারা রিং লাইগেশনের উপযোগী নয় এবং যাদের লংগো মেশিনের খরচ বহনে অক্ষমতা আছে। আবার কেউ লেজার চিকিৎসা করতে চাইলে তাতেও প্রচলিত পদ্ধতির মতই লেজার দ্বারা তিনটি মাংসপিন্ড কাটা হয়।
পার্থক্য কেবল লেজার দিয়ে করা আর প্রচলিত অপারেশনে সার্জিক্যাল নাইফ দ্বারা কাটা হয়। লেজার পদ্ধতিতেও প্রচলিত পদ্ধতির মত ক্ষত শুকাতে ১-২ মাস সময় নিতে পারে, আবার জটিলতা গুলো প্রচলিত পদ্ধতির মতই হতে পারে।
তাই বলা যায় লেজার পদ্ধতিতে বিশেষ কোন সুবিধা নেই।
এছাড়া পাইলস চিকিৎসায় আরো কিছু পদ্ধতি হলোঃ
ক্রায়োথেরাপি,ইনফ্রারেড ফটোকোয়াগুলেশন,এনাল ডায়লেটেশন,ইনজেকশন,ইলেকট্রোকোয়াগুলেশন ইত্যাদি।
সব ধরণের পদ্ধতির সুবিধা অসুবিধা ভাবলে বর্তমানে প্রচলিত তিনটি পদ্ধতির কথা বলা যায়।
রিং লাইগেশন,লংগো এবং প্রচলিত অপারেশনের পদ্ধতি।
যার মধ্যে লংগো ও অপারেশন একশো এর কাছাকাছি সফল।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে উপশমের উপায়-
ঘরোয়া পদ্ধতিতে অর্শ রোগের যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব হয়। এর জন্যে যা যা করতে হবে-
১. অ্যালোভেরা জেলঃ এটি করে তা মলদ্বারের ফোলা অংশে লাগান। এই জেল আরামদায়ক এবং চুলকানির উপশমের কারণ হতে পারে। এটি জেল করে ফ্রিজে রেখে বরফ করেও লাগাতে পারেন দিনে কয়েকবার।
২.কালোজিরা পেস্টঃ কালোজিরা অনেক রোগের মত অর্শ রোগেরও উপশমে সাহায্য করে। কালোজিরার পেস্ট করে তা মলদ্বারের ফোলা স্থানে ব্যবহার করতে পারেন।
৩. আপেল সিডার ভিনেগারঃ আপেল সিডার একটি কার্যকরী ঔষধ হতে পারে অর্শ রোগের জন্যে। এক গ্লাস পানিতে এক চামুক আপেল সিডার ও এক চামুচ মধু দিয়ে পান করলে উপকারীতা পাবেন। এছাড়া বাহ্যিক অর্শের জন্যে তুলোয় করে ক্ষতস্থানে লাগান। এতে কিছুক্ষণ জ্বালা পোড়া করলেও পরে আরাম পাবেন। এটিও দিনে বেশ কয়েকবার ব্যবহার করুন।
৪. বরফঃ ক্ষতস্থানে বরফ ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যথা উপশম হবে। দিনে কয়েকবার বেশ কিছুক্ষণ বরফের টুকরা কাপড়ে প্যাঁচিয়ে ব্যথার স্থানে ধরুণ।
৫.অলিভ অয়েলঃ অলিভ অয়েল খেলে প্রদাহ কমে তাই অলিভ অয়েল খাওয়ার মাধ্যমে অর্শ রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। দিনে এক চামুচ পরিমাণ অলিভ অয়েল খেতে পারেন।
৬.লেবু,মধু ও আদাঃ লেবুর রস আর আদা,মধু মিশিয়ে খান। দিনে দুবার এই মিশ্রণ খাওয়ার মাধ্যমে অর্শ রোগ নিয়ন্ত্রণে আসে।
সাময়িক ঘরোয়া পদ্ধতি কাজে না দিলে অতিব জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে রোগীকে।
প্রতিরোধ–
প্রতিকার থেকে প্রতিরোধ ভালো এই কথাটি আমরা কে না জানি। তাই অর্শ রোগের মত একটি জটিল ও যন্ত্রণাদায়ক রোগের প্রতিরোধই আমাদের সকলের কাম্য। তাই অর্শ প্রতিরোধ কি কি করণীয় জেনে নিনঃ
১.নিয়মিত মলত্যাগ করা।
২.শাক-সবজি ও সবুজ ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস করা।
৩. দিনে অন্তত ৭-৮ গ্লাস পানি পান করা।
৪. নিয়মিত ব্যয়াম করা।
৫. ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস পরিত্যাগ করা।
৬.অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলা।
৭. পেঁপের সালাদ বা রান্না করা পেঁপে খাওয়া। এতে এনজাইম থাকে যা অর্শ রোগ উপশমে ও প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৮. সকালবেলা খালি পেটে ইসুফগুলের ভুষি খান।
৯. অতিরিক্ত তেল চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
১০. অতিরিক্ত মাংস এড়িয়ে চলুন, মাংস খেলে তার সাথে পর্যাপ্ত পানি ও শাকসবজি আহার করুন।
১১.বাদাম,অটটস ও লৌহ সমৃদ্ধ খাবার খান।
১২. দুধ জাতীয় খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়ায় তাই অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
১৩. অধিক সময় টয়লেটে অবস্থান থেকে বিরত থাকুন।
একটি সুন্দর ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন পদ্ধতি আমাদের শুধু অর্শ নয় বরং অনেক রোগ থেকেই রক্ষা করতে পারে। তাই সুষ্ঠ ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন পদ্ধতির মাধ্যমে অর্শ রোগের প্রতিরোধ করুন।
উপসংহার–
পরিশেষে বলা যায়, যে কোন রোগকেই প্রশ্রয় না দিয়ে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের শরীরে চাহিদা গুলো আলাদা। তাই রোগশোকও আলাদা। একারণে অন্যের পরামর্শে নিজের ক্ষতি না করে পাইলস বা অর্শ রোগ হলে
ডাক্তারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষার মাধ্যমে রোগ নিরূপণ করে পর্যাপ্ত চিকিৎসা গ্রহণ করুন।